-->

প্রসঙ্গ পৌরাণিক দেব-দেবী : রবীন্দ্র-কবিতার প্রেক্ষিতে - ড. চঞ্চলকুমার মণ্ডল

 

প্রসঙ্গ পৌরাণিক দেব-দেবী : রবীন্দ্র-কবিতার প্রেক্ষিতে


এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। প্রতিকূল পরিবেশের সাথে মানুষ প্রতিনিয়ত লড়াই করে টিকে থাকতে গিয়ে যখন যেখানে বিপর্যস্ত হয়েছে; সেই বিধ্বস্ত দুর্বল মুহূর্তে কল্পনার সাহায্যে এক অদৃষ্টময় ঐশ্বরিক ক্ষমতার উপস্থিতি অনুভব করার চেষ্টা করেছে। এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্ম-রহস্য নিয়ে যেমন অনন্ত কৌতূহল; তেমনি, মানুষ তাঁর জন্ম-মৃত্যুর রহস্য ভেদ করতে গিয়ে নানান কল্পনা গড়ে নিয়েছে। সেই সব মানস কল্পনা-সজ্ঞা বিষয়ের মধ্যে ঐশ্বরিক ক্ষমতার অস্তিত্ব নিয়ে মানুষ শুভ-অশুভ, মঙ্গল-অমঙ্গল নিয়ে শঙ্কিত চিত্তে একে-একে নানান দেব-দেবী গড়ে তুলেছে। এইভাবেই, পৌরাণিক দেব-দেবী নানান জন-গোষ্ঠীর ও সম্প্রদায়ের মধ্যে কুসংস্কারের শৃঙ্খল ভাঙার প্রয়াসে ‘মিথ’ কল্প রূপে একে একে গড়ে উঠেছে। এমনকি, ঐ সকল দেব-দেবীর মাহাত্ম্য-গীতি নিয়ে পরবর্তী কালে কতই না কল্প-কাহিনী গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ‘মিথ’ নির্ভর সুপ্রাচীন ভক্তিবাদী কবি-শিল্পী গণের লেখনী মুনশিয়ানায়ক্রমে সেই ভক্তি বাদীর যুগ মানবতাবাদীতে বিবর্তন ঘটেছে। দেব-দেবীর আড়ালে মানব-সংসারের কথাই চিত্রিত করায় কবি-শিল্পীগণ তৎপর হয়েছে। স্বর্গের কাল্পনিক দেব-দেবী মর্ত্যের ধূলি-ধূসর মানব সংসারের মাঝে নেমে এলেন। ‘মিথ’ ভাবনায় মানব ভাবনাই ক্রমে মুখ্য হয়ে উঠল।

        আলোচ্য রবীন্দ্র কবি-মানসে সেই ‘মিথ’ ভাবনা, মানব ভাবনায় প্রাধান্য পেল। কবির চোখে দেখা জীবন-দেবতা হলেন, মানব দেবতা। এক কথায়, রবীন্দ্র কাব্য মানসে আধ্যাত্মিকতা, মানবতা বাদেরই নামান্তর। তাই, পুরাণকে আশ্রয়মাত্র করে কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্য-ভাবনাকে জীবন ভাবনায় প্রোজ্জ্বল করে তুলেছেন। জীবন সত্যের অনুসন্ধানে তিনি বাংলা কবিতায় পুরাণের নবরূপায়ন ঘটালেন। রবীন্দ্র-কাব্য দৃষ্টিতে পুরাণ-কথার আনুষঙ্গিক শব্দ-বন্ধনে বর্ণময় রূপকল্প ‘মিথ’ তৈরী হতে থাকে। তাঁর কাব্য ভাবনায় পুরাণের জগতে কেবল বিচরণ করা নয়; পুরাণ কথায় ঐ ‘মিথ’ অনুষঙ্গ মাত্র। পুরাণ কথায় দৃশ্যের পর দৃশ্যে কোনো বর্ণনায় না গিয়ে, তিনি নিজের মতো করেই ‘মিথ’ নির্মাণ করেছেন।

        রবীন্দ্রনাথ, ঠাকুর বাড়ির যে পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন সেখানে বেদ চর্চা, উপনিষদ পাঠ নিয়মিত হতো। ঠাকুর বাড়ির প্রভাত শুরু হতো বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে। সুতরাং, গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণের চিরায়ত অভ্যাসে রবীন্দ্র-কবি-মানসে ‘মিথ’ ভাবনা যে একটা স্বতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছিল, তাতে কোনো সংশয় নেই। তাছাড়া, কিশোর রবীন্দ্রনাথ ভৃত্য শ্যাম দ্বারা লক্ষ্মণের গণ্ডীর রেখায় বন্দী জীবন এবং ভৃত্য শ্বরের মুখে শোনা রামায়ণ কাহিনী, দাশুরায়ের পাঁচালী গান – এ সবই রবীন্দ্র-কবি মানসে একটা গভীর দাগ কেটেছিল। পরবর্তী কালে ঐ রামায়ণ কাহিনী তাই রবীন্দ্র কবিতায় ‘মিথ’ নির্মাণে সহায়তা করেছে। যেমন – ‘অহল্যার প্রতি’, ‘পতিতা’, ‘ভাষা ও ছন্দ’ এবং ‘চৈতালি’ কাব্যের সনেট জাতীয় কবিতা, ‘বনে ও রাজ্যে’। এমনকি, ‘সোনার তরী’র ‘পুরস্কার’ এবং ‘মানসী’ কাব্যের ‘কুহুধ্বনি’-তে ঐ রামায়ণ কথার অনুষঙ্গে ‘মিথ’ নির্মিত হয়েছে। আসলে, ভারতবর্ষীয় পৌরাণিক দেব-দেবীর প্রতি কবির স্বতন্ত্র একটা শ্রদ্ধা ও দুর্বার আকর্ষণ বোধ ছিল। জাবালা, সত্যকাম, অহল্যা-উর্বশী, নারদ, বাল্মীকি, অর্জুন সারথি শ্রীকৃষ্ণ সহ শিব ও মদন প্রভৃতি অসংখ্য পুরাণ মহাকাব্য, বেদ, উপনিষদীয় এমনকি, ঐ বৈষ্ণবীয় ও বৌদ্ধ ধর্মের সুপ্রাচীন মুনি-ঋষি গণকে পর্যন্ত ছায়ামাত্র করে পুরাণ প্রতিমার নবায়নে ‘মিথ’ নির্মাণ করেছেন।

‘শেষসপ্তক’ (১৯৩৫) কাব্যের ৩৭ সংখ্যক কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঐ পৌরাণিক প্রসঙ্গটি তুলে ধরে ‘মিথ’ কল্পনায় উমাকে ‘বিশ্বলক্ষ্মী’ রূপে সম্বোধন করে বলেছেন –

“বিশ্বলক্ষ্মী,

তুমি একদিন বৈশাখে

বসে ছিলে দারুণ তপস্যায়

রুদ্রের চরণ তলে।”

রুদ্রের চরণ তলে তপস্যায় রত উমাকে রবীন্দ্রনাথ নারী রূপে এঁকেছেন। যে নারী প্রকৃতির কোলে সাধনায় বসেছে বিশ্বের মঙ্গলের জন্য। এই কাব্যের ‘আষাঢ়’ কবিতায় কবি উমাকে ‘বিশ্বলক্ষ্মী’ রূপে সম্বোধন করে বিশ্বের মঙ্গল সাধনায় রত উমার আরাধিকা মূর্তির ছবি এঁকেছেন।

“নব বরষার দিন

বিশ্বলক্ষ্মী তুমি আজ নবীন গৌরবে সীমাহীন

রিক্ত তপ্ত দিবসের নীরব প্রহরে

ধরণীর দৈন্য ’পরে

ছিলে তপস্যায় রত

রুদ্রের চরণতলে নত।”

রুদ্রের চরণ তলে উমা-বিশ্বলক্ষ্মী রূপে সাধনায় রত হয়ে থাকে বলেই প্রকৃতি এত মনোরম, শস্য-শ্যামলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। উমা নিজে সাধনায় নিমগ্ন থেকে দেহ উপবাসে রুক্ষ-শুষ্ক হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির শুষ্ক রূপে তারই ইঙ্গিত মেলে। উমার সাধনা নিমগ্ন চিত্তে ঐ বিশ্বলক্ষ্মী হয়ে ওঠার রূপচিত্র প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমালোচক তাই যথার্থই বর্ণময় রূপে বলেছেন –

“বিশ্বলক্ষ্মীই প্রকৃতির শক্তি, শ্যামলতা এবং সৌন্দর্যের জন্য দায়ী। বৈশাখের দারুণ তাপে প্রকৃতির রুক্ষ শুষ্ক রূপ জেগে ওঠে। মনে হয় বিশ্বলক্ষ্মী বুঝি রুদ্রের চরণতলে তপস্যায় বসেছে, তাই তার দেহ উপবাসে শীর্ণ, কেশপাতা পিঙ্গল। কিন্তু বিশ্বলক্ষ্মীই দুঃখকে দগ্ধ করলে দুঃখেরই দহনে, শুষ্ককে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিলে পূজার পুণ্য ধূপে, কালোকে করল আলো, নিস্তেজকে দিলে তেজ, ত্যাগের হোমাগ্নিতে ভোগ গেল পুড়ে, রুদ্রের প্রসন্নতা জাগলো মেঘগর্জনে, মরুবক্ষে তৃণের শ্যামাও আস্তরণ দিলে পেতে – সুন্দরের আবির্ভাব ঘটলো। প্রকৃতির এই স্নিগ্ধ শ্যামলা নয়নাভিরাম রূপ – বিশ্বলক্ষ্মীরই দাক্ষিণ্যে তা সম্ভব, তারই সাধনার ফসলে তা ঘটেছে।”

        রবীন্দ্র কবিতায় ‘মিথ’ ভাবনায় রুদ্রদেব একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। অনাদিনাথ রুদ্রদেব তথা পৌরাণিক ‘শিব’ চরিত্র রবীন্দ্র-কাব্য মানসের আষ্টেপৃষ্ঠে যেন জাঁকিয়ে বসেছিল। রবীন্দ্র-কবি মানসের অত্যন্ত প্রিয় পৌরাণিক চরিত্র এই রুদ্রদেব। যিনি প্রলয়ংকারী ধ্বংস, আবার সৃষ্টির দেবতাও। এই দেবতার পরিচয় সম্পর্কে ‘পৌরাণিক অভিধান’- বলা হয়েছে –

“রুদ্রের রূপ-কল্পনা ও গুণধর্ম এইরূপ – রুদ্রের হাত আছে, তার ওষ্ঠ সুন্দর তিনি কদর্প (জটাকেশ)। তাঁর বর্ণ পিঙ্গল, উজ্জ্বল সূর্যের মতো দীপ্তিশালী। তিনি রথারূঢ় হয়ে বিচরণ করেন। তাঁর হস্তে বজ্র এবং আকাশ হতে তিনি বজ্র নিক্ষেপ করেন। রুদ্র ভয়াবহ বন্য জন্তুর মতো ধ্বংসকারী।”

রুদ্রের ঐ প্রলয়ংকারী-ধ্বংসাত্মক রূপটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মিথ’ ভাবনায় বার-বার একাধিক কবিতায় ব্যবহার করেছেন। ধ্বংসের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি; প্রলয়ের মধ্য দিয়ে মঙ্গল ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠাই রুদ্রদেবের একমাত্র কাজ। শিবের নটরাজ মূর্তি, রুদ্রদেব হিসেবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ বার-বার কবিতায় ও গানে এই দেবতারই চিত্রকল্প এঁকেছেন। ‘প্রভাত সংগীত’ কাব্যের ‘সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়’ কবিতায় কবি সেই ধ্যান নিমগ্ন জটাজুট শিবকে জাগাতে চেয়েছেন –

“জাগো জাগো জাগো মহাদেব,”

ডমরুধর শিব জেগে উঠলেই পৃথিবীর সংকট ঘুচে যাবে। তাঁর প্রলয়ংকারী, নটরাজ নৃত্যে সৃষ্টি যেমন টালমাটাল হয়ে ওঠে; তেমনি, ঐ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির পথ তৈরী হয়। ডমরুধরের ডমরুর ছন্দে মরণ সংগীত বেজে ওঠে। যে সংগীতের ভেতর দিয়ে নবজীবনের বার্তা দ্যোতিত হয় –

“জাগিয়া উঠিল মহেশ্বর,

তিন-কাল ত্রিনয়ন মেলি

হেরিলেন দিক্‌ - দিগন্ত!

প্রলয়পিণাক তুলি         করে ধরিলেন শূলী

পদতলে জগৎ চাপিয়া,

জগতের আদি-অন্ত       থরথর থরথর

উঠিল কাঁপিয়া।”

এই মহাদেবের জাগরণে যেমন ধরাতল কেঁপে ওঠে; তেমনি আবার ধ্যানমগ্ন হয়েও রুদ্রদেব এই ধরাধামকে মহাপ্রলয়ের হাত থেকে রক্ষা করে থাকেন। সৃষ্টি-স্থিতি-লয় সবিই রুদ্রদেবের হাতে। তাই তিনি সর্বক্ষণ ঐ –

“অনন্ত-আকাশ-গ্রাসী অনল সমুদ্র-মাঝে

মহাদেব মুদি ত্রিনয়ন

করিতে লাগিলা মহাধ্যান।।”

এই ধ্যানরত শিব দ্বারাই মহাবিশ্বের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় রক্ষিত। রবীন্দ্র-কাব্য মানসের ‘মিথ’ ভাবনায় শিব কেবল ধংসের নয়; তিনি সৃষ্টি রক্ষারও দেবতা। তিনি অন্ধকারকে সংহার করে আলোর বন্যা বইয়ে দেন। ধ্বংস অর্থে, বিনাশ নয়; নতুনের ইঙ্গিত বয়ে আনে। তাই শিবের আরে নাম মহাকাল। সেই মহাকালের প্রলয় মূর্তি রবীন্দ্র-কাব্যের ‘মিথ’ ভাবনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে। নটরাজের নৃত্যন্দে কবি মহিমান্বিত হয়ে তাই গেয়ে ওঠেন;

“প্রলয় নাচন যখন আপন ভুলে

হে নটরাজ, জটার বাঁধন পড়ল খুলে।”

রুদ্রের এই বিধ্বংসী রূপ কবিকে এক সময় মুক্তি এনে দিয়েছিল। ‘বনবাণী’র ‘নটরাজ ঋতুরঙ্গশালা’তে কবি সেই মুক্তির আনন্দে গেয়ে উঠেছেন ঐ ‘নটরাজের নাট্যশালে’। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর এই কাব্য মানসে মিথ ভাবনায় রুদ্রদেব যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে সে প্রসঙ্গে ‘শান্তিনিকেতন’ পত্রিকার ১৩২২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় বর্ণনা করে লিখেছেন –

“১৩০৫ সালে বর্ষশেষ ও দিনশেষের মুহূর্তে একটা প্রকাণ্ড ঝড় দেখেছি। ... এই ঝড়ে আমার কাছে রুদ্রের আহ্বান এসেছিল। যা কিছু পুরাতন ও জীর্ণতার আসক্তি ত্যাগ করতে হবে – ঝড় এসে শুকনো পাতা উড়িয়ে দিয়ে সেই ডাক দিয়ে গেল। এমনি ভাবে, চির নবীন যিনি, তিনি প্রলয়কে পাঠিয়েছিলেন মোহের আবরণ উড়িয়ে দেবার জন্যে। তিনি জীর্ণতার আড়াল সরিয়ে দিয়ে আপনাকে প্রকাশ করলেন। ঝড় থামল। বললুম – অভ্যস্ত কর্ম নিয়ে এই যে এতদিন কাটালুম, এতে চিত্ত তো প্রসন্ন হলো না। যে আশ্রম জীর্ণ হয়ে যায়, তাকেও নিজের হাতে ভাঙতে মমতায় বাধা দেয়। ঝড় এসে আমার মনের ভিতরে তার ভিতকে নাড়া দিয়ে গেল, আমি বুঝলুম বেরিয়ে আসতে হবে।”

কল্পনা’ (১৯০০) কাব্যের ‘বর্ষশেষ’ (১৮৯৯) কবিতাটির উৎস প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং উক্ত বর্ণনাটি দিয়েছেন। আসলে, নটরাজের প্রলয়কারী-বিধ্বংসী রূপের মাঝে কবি ঐ ইংরেজ প্রভুর প্রচণ্ড দানব শক্তির বিনাশ চেয়েছেন। পরাধীন ভারতবর্ষের গ্লানি মুছে ফেলতে চেয়ে কবি নটরাজের নৃত্যের আহ্বান করেছেন। ধ্বংসের মধ্য দিয়ে, ঐ ইংরেজ শক্তির (অশুভ শক্তির) বিনাশের মধ্য দিয়ে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা (স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা)-র স্বপ্ন দেখেছেন কবি। কবির ‘মিথ’ ভাবনা রুদ্র শক্তি শিবের পরিকল্পনা, ঐ সাম্রাজ্য লোভী ইংরেজ শক্তির বিনাশে শুভ শক্তির জয়; স্বদেশবাসীর জয়ের স্বপ্ন দেখেছেন কবি। তাই রুদ্রদেবের আহ্বান জানিয়ে ‘সুপ্রভাত’ (১৯০৭) কবিতায় কবি বলেন-

“রুদ্র, তোমার দারুণ দীপ্তি

এসেছে দুয়ার ভেদিয়া;”

এমনকি, ঐ স্বার্থলোভী ব্রিটিশ শক্তির বর্বরোচিত আচরণকে দানবের সঙ্গে তুলনা করে কবি ‘নৈবেদ্য’ কাব্যের ৬৫ সংখ্যক কবিতায় প্রার্থনা করেছেন, রুদ্রের বজ্র গর্জন যেন ঐ অত্যাচারী ইংরেজ শক্তির ওপর ধেয়ে আসে –

“স্বার্থ যত পূর্ণ হয় লোভ ক্ষুধানল,

তত তার বেড়ে ওঠে বিশ্বধরাতল।

আপনার খাদ্য বলি না করি বিচার,

জঠরে পুরিতে চায় বীভৎস আহার।

বীভৎস ক্ষুধারে করে নির্দয় নিলাজ

তখন গর্জিয়া নামে তব রুদ্র বাজ।”

রবীন্দ্র-কাব্য মানসের এই ‘মিথ’ ভাবনায় রুদ্রদেবের মূর্তি পরিকল্পনা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমালোচক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মহাশয় তাই যথার্থই বলেছেন –

“সাম্রাজ্য লোভী ইংরেজ সমস্ত ন্যায়ধর্ম ও মানবতাকে পদদলিত করিয়া ভারতের বন্ধনমুক্তির আশাকে নির্মূল করিতেছে; তখন তাহার আশাবাদী, আদর্শবাদী কবি মনে একটা ভীষণ প্রতিক্রিয়া দেখা দিল, ইংরেজের নির্বিচার দমননীতিতে তিনি একটা ঘোর দুর্দিনের অন্ধকারে চারিদিক আচ্ছন্ন দেখিতে পাইলেন ... মানব মহত্ত্বে একান্ত বিশ্বাসী কবি মানবের সভ্যতা-সংস্কৃতি ধ্বংসকারী এই রক্তলোলুপ দানবদের শত ধিক্কার দিয়াছেন, আর এই মানুষ্যনাশী দানবদের প্রতিরোধ করিবার জন্য সংগ্রামী জনগণের প্রস্তুতিরও ইঙ্গিত করিয়াছেন।”

এই রুদ্রদেবের আবির্ভাবে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটবে। কেটে যাবে অমানিশার অন্ধকার। অশুভের বিনাশ ঘটিয়ে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে রবীন্দ্র-কবি মানসে, পুরাণের ‘শিব’ ‘সুপ্রভাত’ কবিতায় ‘আঁধার-মহিষ’ রূপে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে আস্ফালন করে ওঠে –

“অমানিশা গেল ফাটিয়া

তোমার খড়্গ আঁধার মহিষে

দুখানা করিল কাটিয়া।”

এখানে, কবি ‘আঁধার-মহিষ’ রূপকের আড়ালে যম দেবের ইঙ্গিত করেছেন। কারণ, যমের বাহন তো কালো মহিষ। আর ঐ রুদ্রদেবের খড়্গাঘাতে যমরাজের শাস্তি বিধানের মতো অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটলো ঐ ‘আঁধার মহিষ’ দু’ভাগ হয়ে গিয়ে। যমরাজের বাহন কালো মহিষকে হত্যা করে কবি মৃত্যকেও ধ্বংস করলেন। কবির এই ‘মিথ’ ভাবনার ‘কালো-মহিষ’ রূপক-পরিকল্পনা প্রসঙ্গটি বিশিষ্ট সমালোচক তাই যথার্থই ব্যাখ্যা দিয়েছেন –

“আঁধার মহিষ হচ্ছে রূপক অলংকার। ... মহিষ যমের বাহন। বাহনকে বলি দিয়ে রুদ্র এখানে প্রতীকীভাবে মৃত্যুকেও ধ্বংস করলেন। ... একটা বৃহদাকার মহিষকে বলি দিতে হলে খড়গাঘাত করতে হবে কোথায়? অবশ্যই ঘাড়ে। ... এবার কর্তিত গোই ঘাড়ের গোলাকৃতি রক্তাক্ত প্রস্থচ্ছেদটি লক্ষ্য করুন। দেখবেন ওইখানে ... ঠিক ওই খানে জবাকুসুম-সঙ্কাশ সূর্য উঠেছে।”

        ‘বলাকা’ পর্বে এসেও কবি সেই রুদ্রদেবের আহ্বান করেছেন বার-বার। ‘সবুজের অভিযান’-এ ‘ভোলানাথের ঝোলা ঝুলি ঝেড়ে’ কবি সংসার বিমুখ সন্ন্যাসী শিবের স্মরণ করেছেন। ২-য় সংখ্যক কবিতায় কবি ভোলানাথকে ‘সর্বনেশে’ বলে চিহ্নিত করেছেন। বাঁধভাঙা যৌবনের উচ্ছ্বাসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবেগে ঝাঁপিয়ে পড়তে কবি উৎসাহিত করেন ঐ ‘মিথ’ ভাবনায়।

“এবার যে ওই এল সর্বনেশে গো।

বেদনায় যে বান ডেকেছে,

রোদনে যায় ভেসে গো!”

কবির ঐ রোদন তথা, কান্না কিসের জন্য? এত বেদনা কিসের? আসলে, ঐ ‘বলাকা’ পর্বের পটভূমিতেই কবির পুরাণ অনুষঙ্গের রুদ্রভাবনা লুকিয়ে রয়েছে। বিশিষ্ট সমালোচক তাই বলেছেন –

“বলাকা কাব্য-পর্ব থেকে কবি রুদ্র কল্পনার পটভূমির বদল হল। তখনও বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়নি, তবে যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংবেদনশীল কবি বুঝতে পারলেন এক ভয়ঙ্কর সর্বনাশের আবির্ভাব আসন্ন। বিশ্বব্যাপী মানুষের উপর আসন্ন দুর্যোগ ও হানাহানির আশঙ্কায় কবি বেদনায় মুহ্যমান হয়ে পড়লেন। এন্ডরুজকে লিখিত পত্রাবলীতে তাঁর এই মানসিক ক্লেশের পরিচয় আছে। ‘বলাকা’-র কবিতাগুলিও তাঁর মনের এই ক্লেশ বহন করছে। গোটা মানব জাতির সেই গভীরতম সংকটের দিনে কবি রুদ্রকে বার-বার স্মরণ করেছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে রুদ্রই মানুষকে সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারেন।”

সুতরাং রবীন্দ্র-কবিতার মিথ ভাবনায় রুদ্রদেব হলেন অশুভের বিনাশক আর, শুভা-শুভের প্রতিষ্ঠাতা। মঙ্গল প্রতিষ্ঠাতা, কল্যাণকারী দেবতা। যিনি, ঝড়ের মাতনে সবকিছু তছ্‌নছ্‌ করে আবার, নতুন করে সবকিছু প্রতিষ্ঠা করেন। কবি সেই রুদ্রদেবের আহ্বান ‘বলাকা’র তিন-সংখ্যক কবিতায় শুনিয়েছেন –

“রুদ্র মোদের হাঁক দিয়েছে

বাজিয়ে আপন তূর্য।

মাথার ’পরে ডাক দিয়েছে

মধ্যদিনের সূর্য।”

এই রুদ্রদেব সমুদ্র মন্থনে উত্থিত বিষকে কণ্ঠে ধারণ করে ‘নীলকণ্ঠ’ হয়ে ওঠেন। যিনি সমুদ্র মন্থনের ক্ষমতা রাখেন, সেই হর-হর মহাদেবকে কবি স্মরণ করে মনে-প্রাণে দৈব শক্তি এনে বলেন, -

“মৃত্যু সাগর মন্থর ক’রে

অমৃতরস আনব হ’রে।”

আবার, ‘ভারততীর্থ’ কবিতায়ও কবি একিই ভাবে রুদ্রবীণার আহ্বান জানিয়েছেন –

“হে রুদ্রবীনা, বাজো, বাজো, ঘৃণা করি দূরে আছে যারা আজও

বন্ধ নাশিবে – তারাও আসিবে দাঁড়াবে ঘিরে

এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।”

সুতরাং জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল মানবের মাঝেই কবি ঈশ্বরকে উপলব্ধির কথা বলেছেন। রবীন্দ্র-কাব্য মানসের ‘মিথ’ ভাবনা তাই মানব-ভাবনারই নামান্তর। বিশিষ্ট সমালোচক তাই যথার্থই বলেছেন -

“মন্দিরের মধ্যে সমস্ত মানব-সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যে আরাধনা তাহা তো জগন্নাথের আরাধনা নহে, ... সমস্তকে স্বীকার করিলে তবেই অনন্ত অসীম পরমেশ্বরের সম্যক্‌ ও উপলব্ধি হইবে...।”

আর তাইতো রবীন্দ্রনাথ মানবতার হীন অপমানে, ব্যথিত চিত্তে ‘মানবপুত্র’ কবিতায় প্রশ্নবাণে ঝঙ্কার তুলে বলেন –

“হে মানুষ, হে মানুষের ঈশ্বর,

কেন আমাকে ত্যাগ করলে!”

রবীন্দ্র-কবি মানসের মিথ ভাবনায় রুদ্রদেবের পর এবার মনসা দেবীর প্রসঙ্গে আসা যাক। ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের হৃদয় বিদারী কাহিনী সতী নারী বেহুলার কলার ভেলায় করে মৃত স্বামী লখিন্দরকে নিয়ে স্বর্গরাজ্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানোর দৃশ্যপট। যা রবীন্দ্র-কাব্য মানসে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। তাই, সর্প দেবী মনসা, কিংবা বেহুলার নদী পথে যাত্রার সেই কালিন্দী নদী ঘুরে-ফিরে এসেছে। ‘প্রান্তিক’ কাব্যের একটি চরণে কবি সেই কালিন্দী নদীর অনুষঙ্গে লেখেন –

“দেহ মোর ভেসে যায় কালো কালিন্দীর স্রোত বাহি।”

চির শান্তির বাণী বাহক রবীন্দ্রনাথের ‘মিথ’ ভানায় এই ‘প্রান্তিক’ (১৯৩৭) কাব্য সংকলনের ১৮-সংখ্যক কবিতায় কবি সেই মনসাদেবীর বাহন নাগ সাপের অনুষঙ্গে দেশের বিপন্ন পরিস্থিতির ইঙ্গিত তুলে ধরেছেন –

“নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস

শান্তির ললিতবাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।”

        শুভ-অশুভের দ্বন্দ্বে কবি মন উদ্বেল হয়ে উঠেছে। চারপাশের বিপর্যস্ত পরিবেশ দেখে উদ্বিগ্ন কবি মন ‘মিথ’ ভাবনায় ফনাধারী সর্পদেবীর কল্পনায় সামাজিক ব্যাধি নিরাময়ের স্বপ্ন দেখেছেন। অষ্ট্রিক জাতির চিরায়ত আস্থাকল্প সর্পদেবীতে ভরসা রেখে কবি নাগদেবের উপস্থাপন করেন। সমালোচকের মতে –

“চতুষ্পার্শ্বের বহমান ইতিহাস দেখে কবি ভুলতে পারেন না যে পৃথিবীতে মাঝে মাঝেই জেগে ওঠে ‘আধপোষা নাগদানব, ফণা তুলতে থাকে, আঘাত করে, ছারখার করে দেয় বহু বছরের গড়ে তোলা সৃষ্টিকে। শুভ এবং অশুভ এই দুই মিলিয়েই রচিত পৃথিবীর পাদপীঠ ... কবিও শুভা-শুভের দ্বন্দ্বে ক্ষতলাঞ্ছিত, কিন্তু তথাপি পৃথিবীকে প্রণতি জানাতে তাঁর দ্বিধা নেই।”

আবারও যদি কবির সেই ‘বলাকা’ কাব্যের দিকে পুনরায় ফিরে তাকানো যায়, সেখানে দেখা যাবে ঐ মনসা দেবীই শুধু নয়; চার সংখ্যক পূর্বোক্ত ‘শঙ্খ’ কবিতায় দেবী কালীকার অনুষঙ্গ ‘মিথ’ কল্পে ধরা পড়েছে। শঙ্খের অভয় বাণী যে শুনেছে, তার পক্ষে কেবল গৃহের কোণে সন্ধ্যারতির দীপ জ্বেলে বসে থাকা সম্ভব নয়। রজনীগন্ধার স্নিগ্ধতা তাকে মুগ্ধ করতে পারে না। সংগ্রামের প্রস্তুতি হিসেবে; তাকে ঐ খর্পর ধারিণী, উলঙ্গিনী শ্যামা মায়ের চরণাশ্রিত সংগ্রামের দ্যোতক রক্তজবার মালা গাঁথতে হবে –

“আরতি-দীপ এই কি জ্বালা

এই কি আমার সন্ধ্যা।

গাঁথব রক্ত জবার মালা

হায় রজনীগন্ধা!”

এখানে ঐ ‘রক্তজবা’র প্রতীকে দেবী কালীকার প্রচণ্ড উন্মত্ত প্রায় শক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। শুধু এই কালীকা দেবীই নয়; ‘মানসী’ কাব্যের ‘সুরদাসের প্রার্থনা’ কবিতার ‘মিথ’ ভাবনায় গঙ্গাদেবীর অনুষঙ্গও উঠে এসেছে। পাপীকে পাপ থেকে উদ্ধারের জন্য গঙ্গা’র মর্তাবতরণ ঘটেছিল। কবি সেই গঙ্গাদেবীর আরেকবার মর্তে অবতরণ প্রার্থনা করেছেন ভক্তসাধক সুরদাসের মধ্য দিয়ে –

“দেবের করুণা মানবী-আকারে,

আনন্দধারা বিশ্ব-মাঝারে,

পতিতপাবনী গঙ্গা যেমন এলেন পাপীর কাজে,

তোমার চরিত রবে নির্মল,

তোমার ধর্ম রবে উজ্জ্বল

আমার এ পাপ করি দাও লীন তোমার পুণ্য-মাঝে।।”

এভাবে, শিব-কালী, লক্ষ্মী-নারায়ণ, দেবী সরস্বতী সহ বহু দেব-দেবী রবীন্দ্র-কাব্য পরিক্রমার ‘মিথ’ ভাবনায় উঠে এসেছে।

        রবীন্দ্র-কাব্য আশ্রীত এই সকল দেব-দেবী বিশেষ তাৎপর্যতা লাভ করেছে। যা ভারতীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে বাঙালীর জনমানসে পুনরুজ্জীবিত করেছে। কবির ‘মিথ’ ভাবনা পক্ষান্তরে মানবভাবনারই নবরূপায়ন।

 

তথ্যসূত্র:

১। শুদ্ধসত্ত্ব বসু – রবীন্দ্র কাব্যের গোধূলি পর্যায়, ১৪০৬ বঙ্গাব্দ, পৃ. – ১৪৩।

২। সুধীরচন্দ্র সরকার – পৌরাণিক অভিধান, ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ, পৃ. – ৪৭৬।

৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড), ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ, পৃ. – ৭৩৯-৭৪০।

৪।  উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য – রবীন্দ্র-কাব্য পরিক্রমা, ১৪১৪ বঙ্গাব্দ, পৃ. – ২০-২১।

৫। তপোব্রত ঘোষ – অলংকার পাঠ : দৃষ্টান্ত রবীন্দ্রনাথ, ‘রবীন্দ্রচর্চা - দেবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদিত), সংখ্যা – ৭, আগষ্ট – ২০০৪, পৃ. – ১৭০।

৬। নিমাইচন্দ্র পাল – রবীন্দ্রচেতনায় নটরাজ, ২০০১, পৃ. – ১৫৩।

৭। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় – রবিরশ্মি (দ্বিতীয় খণ্ড – পশ্চিমভাগে), ১৪১০ বঙ্গাব্দে, পৃ. – ১১৩-১১৪।

৮। রবীন পাল – প্রসঙ্গ পৃথিবী, আশিস চক্রবর্তী (সম্পাদিত) ‘রবীন্দ্র কবিতা : তন্নিষ্ঠ পাঠ, ২০০৬, পৃ. – ২২০।