দলিত সাহিত্য : সৃজন ও আন্দোলনে ইতিহাসের নব নির্মাণ
দলিত সাহিত্য
: সৃজন ও আন্দোলনে ইতিহাসের নব নির্মাণ
ড. চঞ্চল কুমার মণ্ডল
বাংলা বিভাগ, সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আন্দোলনের
ইতিহাসে অধুনা সংযোজিত এক বিকল্প সংস্কৃতির ধারা তথা, ‘দলিত সাহিত্য আন্দোলন’
আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমেই স্মরণে আসে কন্নড় দলিত সাহিত্য আন্দোলনের পূরোধা কবি
সিন্ধা লিঙ্গাইয়ার শ্লোগান মুখর কবিতাটি। যেখানে ‘দলিতেরা আসছেন’ এই শিরোনামে কবি
সদর্ভে ঘোষণা করেন,
“দলিতেরা
আসছেন রাস্তা দাও
দলিতের হাতে
রাজ্য দাও
ঠাকুর এবং
দেবতা ছুঁড়ে ড্রেনের জলে
দলিতেরা
আসছেন নিজেরা নিজের পায়ে ভর করে।”
এমন কবিতায় ফুটে উঠে দলিতদের
আত্মজাগরণের মহামন্ত্রধ্বনি। দলিত সাহিত্যিকেরা বেদ বিধি মানে না মানে, তাঁরা
নিরীশ্বরবাদী নন। মনুর শাস্ত্র বিধান ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চায় এই আন্দোলন। এঁরা
প্রতিষ্ঠা করতে চায় এক বিকল্প সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতির ভিতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে এক
ধর্ম, সে ধর্ম ‘মানব ধর্ম’। যে সংস্কৃতির ভেতর দিয়েই বার বার ফুটে উঠে দলিত
সাহিত্যের কবি-লেখকদের নব বৌদ্ধিক চেতনার আলো। তাঁরা বর্ণ ভেদের যুগ যন্ত্রণা মুছে
ফেলতে চায়। বিত্তশালীর পীড়ন, দলন চিরতরে উৎখাতের লক্ষ্যে এক বিকল্প সংস্কৃতি ধারার
আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, আত্মজৈবনিক উপাদানেই ভরিয়ে তোলেন তাঁদের সবকটা সৃষ্টি
সম্ভার। যে সমস্ত সৃষ্টি কলার ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে দলিত লেখকদের হীনজাত হওয়ার সামাজিক
যন্ত্রণা। এ প্রসঙ্গে দলিত সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মনোহর মৌলি বিশ্বাস
যথার্থই মন্তব্য করেছেন –
“দলিত সাহিত্য নিরীশ্বরবাদের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে না। নাস্তিকতায়
পুস্ট হয়ে বিকল্প সংস্কৃতির সন্ধান করে এবং সেই সংস্কৃতি যেখানে জাতিভেদ,
বর্ণভেদের যন্ত্রণা নেই, সেই সংস্কৃতি যেখানে পুরোহিত তন্ত্রের নিকৃষ্ট শোষণ নেই,
সেই সংস্কৃতি যেখানে জন্মের কারণে মানুষের নিকৃষ্ট ও উৎকৃষ্ট হওয়ার তত্ত্ব মেনে
নেয় না, সেই সংস্কৃতি যেখানে ইহকাল ও পরকালের অকারণ মোহে আবিষ্ট হয়ে পড়ে না মানুষ,
সেই সংস্কৃতি যেখানে ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠায় আস্থানেই; দলিত সাহিত্য ও তার
আন্দোলনে তাই-ই কাম্য হয়ে ওঠে।”
কিন্তু এখন প্রশ্ন, এমন একটি
স্বতন্ত্রপূর্ণ বিকল্প সংস্কৃতি ধারার সাহিত্য আন্দোলনের প্রয়োজন দেখা দিল কেন? এর
কারণ হিসাবে বলা যায়, মানুষ মাত্রই জীবনের উত্তরণ চায়। তাই ঐ ‘দলিত’ সম্প্রদায়ের
মানুষও দলনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই কেবল নয়, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে
সাহিত্যের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদও করতে চায়। শোষণের নক্কার জনক ছবি তুলে ধরে, দিন
যাপনের গ্লানিকর মুহূর্তগুলোর যন্ত্রণা ভুলতে চায়। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই দলিতের মধ্য
থেকে উঠে আসা বেশ কয়েকজন শিক্ষিত মানুষ তাঁদের চারপাশের দলনের বীভৎস ছবিকে চিত্রিত
করতে গিয়ে, নির্মাণ করেন এক প্রতিবাদী সাহিত্য ধারা। যা, দলিতদের ‘আত্মজৈবনিক’
উপাদানে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। দলিত সাহিত্য সৃজনের সবচাইতে জোরাল মাধ্যম এই আত্মজৈবনিক
উপাদান। আসলে, ঔপনিবেশিক শাসনের পরবর্তী পর্যায়ে সমাজের নিম্ন সম্প্রদায় ভূক্ত
গোষ্ঠীগুলি বৈদেশিক শিক্ষার আলোকে এসে নিজেদের সংগঠিত করতে শেখে। তাঁরা প্রত্যেকেই
সামাজিক মর্যাদা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভের প্রত্যাশায় আকুল হয়ে ওঠে। যার জলন্ত প্রমান
হিসাবে উল্লেখ করা যায়, ১৮৭০ খ্রী: যখন দেশব্যাপী জনগণনা শুরু হয়। ঐ সময় দক্ষিণ
ভারতে দুই তামিল নিম্ন সম্প্রদায় ভেল্লাস ও পাদাইয়চিনরা, তারা দাবী জানায় উচ্চবর্ণের মতো সমমর্যাদার। তেমনি বিংশ শতকের
প্রথম দশকে বাংলা দেশের নমঃশূদ্রগণও স্বদেশী আন্দোলনের সময় থেকে, বর্ণের দিক থেকে
মর্যাদার উন্নতি চাই ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তে
জ্যোতিরাও ফুলের নেতৃত্বে ধারাবাহিক ভাবে বর্ণবিরোধী আন্দোলনও শুরু হয়েছিল। ঐ
জ্যোতিরাও ফুলেই প্রথম শূদ্র জাতির মানুষ; যিনি ভা্রতের ইতিহাসে এক নতুন ইতিহাস
নির্মাণ করেন। তিনি, ঐ সমস্ত দলিত মানুষদের একত্রিত হয়ে লড়াই করার জন্য ১৮৭৩ খ্রী:
প্রতিষ্ঠা করেন ‘সত্যশোক সমাজ’। তাঁর লেখা গ্রন্থ ‘গোলাম গিরি’ মারাঠা দলিত
সাহিত্যের এক জ্বলন্ত নিদর্শন। ঠিক ঐ সময় বোম্বে থেকেও জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে
তীব্র প্রতিবাদ জানায় ‘আর্য সমাজ’। দলিতের দলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে
তোলার লক্ষ্যে ভারতীয় রাজনীতিতে অনেক জল ঘোলা হয়ে চলেছে। ‘দলিত’ শব্দটির বুৎপত্তিগত
অর্থ এসেছে ‘দলন’ থেকে অর্থাৎ, পায়ে দলে যাওয়া; তথা, দমিয়ে রাখার নানান শোষণ
পক্রিয়া। গান্ধিজী ‘দলিত’ দের ভালোবেসে নাম দেন ‘হরিজন’। অর্থাৎ ‘হরিজন’
অর্থে ভগবানের অংশ। মহাত্মা গান্ধী ‘হরিজন’ পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে
নিম্নবর্গীয় মানুষ ঐ হরিজন সম্প্রদায়ের প্রতি কৃত্রিম ভালোবাসার ফোয়ারা ছোটালেন।
অথচ গান্ধিজীর গুজরাটের ঐ পোর বন্দর এলাকার একটিও হরিজন সম্প্রদায়গ্রস্ত মানুষেরা
বিন্দুমাত্র মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পায়নি। বরং বলা যায়, ঐ ‘দলিত’ শব্দটি আরো জনপ্রিয়তা
লাভ করে ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে মহারাষ্ট্রে ‘দলিত প্যান্থার’ (Dalit
Panthers) নামে সংগঠনটির আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। এই মহারাষ্ট্রের
বৃহত্তম অস্পৃশ্য গোষ্ঠী ‘মাহার’ তথা ‘চামার’ জাতির অন্তর্ভূক্ত ছিলেন ভীমরাও
আম্বেদকর। যিনি, দলিতদের মহাদ এর চাভদার সরোবরের জল থেকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে
রুখে দাঁড়ান। শুধু এই নয়, বিশাল মিছিল নিয়ে ঐ সরোবরের দিকে তিনি যাত্রা করেন।
তারপর বিশাল জনতার সামনে ঐ মাহাদ নগরের রাজপথে, যেখানে হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামির মূল
আকরগ্রন্থ ‘মনুস্মৃতি’ তা পুড়িয়ে দিয়ে জাত-পাতের সংস্কারের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক
ভাষণ রাখেন। দলিত আন্দোলনের ইতিহাসে সেই ১৯২৭-এর ২৫ শে ডিসেম্বর দিনটি তাই অত্যন্ত
স্মরণীয়। দলিত সাহিত্যের চর্চা প্রসঙ্গেও বাবা সাহেব আম্বেদকর বলেছিলেন,-
“Trans
form the light of your pen so that the darkness of villages is removed … Get to
know intimately their pen and sorrow, and try through your literature to bring
progress in their lives.”
দলিতের আত্মজাগরণ তথা আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যম এই দলিত সাহিত্য।
সাহিত্যের এই নব নির্মাণের মধ্য দিয়ে তাঁরা জাগরণের পথ খুঁজে পান। তাঁদের
স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ এই সাহিত্যের নব নির্মাণের মধ্য দিয়ে মেলে ধরেন।
আর একাজে ড. ভীমরাও আম্বেদকরই সর্বপ্রথম দলিতদের হয়ে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার
লক্ষ্যে কেবল সমাজ সংস্কার মূলক কর্ম সূচিতেই খান্ত নন, রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগও
করেন। ‘সাইমন কমিশন’-এর সামনে দাদা সাহেব আম্বেদকর সমস্ত অনুন্নত সম্প্রদায়ের জন্য
পৃথক নির্বাচনের দাবী জানান। শুধু এই নয়, দলিতদের আত্ম মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই-এ
প্রাণসঞ্চারের লক্ষ্যে তিনি আইনি ভাবে নিম্ন সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ করে যান
একেবারে ভারতীয় সংবিধানের খসড়া পত্রে। দলিতদের ‘দলন’ যাতে চিরতরেই নিঃশেষ হয়, সেই
আশায় দিল্লীর সর্বোচ্চ সিংহাসনে তিনি অস্পৃশ্য দের বসার অধিকারও স্থাপন করে যান।
সমস্ত নিম্ন বর্গীয় দের প্রতি তাঁর মহান আদেশ:
“সংবিধানের যে স্থানে
তোমাদের বসিয়ে গেলাম, পৃথিবীর অন্যকোন শাসন ব্যবস্থার সংবিধানে কোনো সংবিধান রচয়িতা
তা করে যাননি। নিজেদের জন্য লড়াইটা তোমরা শুরু করে দাও।”
সেই থেকে দলিত দের ঐ আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু। যে লড়াই
কেবল ভারতীয় রাজনীতিতে নয়। সাহিত্যের সৃজন ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার নব ইতিহাস
নির্মাণ হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। ‘জাত ব্যবস্থার বিলুপ্তি’ তাঁর সেই দলিত সাহিত্য
ধারার চিন্তা-চেতনা মূলক, মতবাদ পুষ্ট গ্রন্থ। এই মহতী উদ্দেশ্যকে পাথেয় করে বিশ
শতকের নব্বই দশকের গোড়ার দিকে কয়েক জন দিল্লী প্রবাসী বাঙালী মিলে গড়ে তোলেন
‘বাঙলা দলিত সাহিত্য সংস্থা’। এই নিয়ে কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে
কয়েকটি সভাও হয়ে থাকে। দলিত তথা, পিছিয়ে পড়া
জাতি-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে
১৯৯২-এর ৫ ও ৬-ই ডিসেম্বর, এই দু’দিন ব্যাপি নদীয়া জেলার প্রান্তিক গাঁ ভায়নাথে
সর্বপ্রথম সঙ্গীতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে দলিত সাহিত্য আন্দোলনে যে সকল
পত্র-পত্রিকা অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছিল সেই সব পত্রপত্রিকার কিছু তালিকা তুলে ধরা যেতে পারে।
সম্পাদক
|
সম্পাদিত পত্রিকা
|
প্রকাশ কাল
|
প্রকাশস্থান
|
রাস বিহারী রায়
|
নমঃশূদ্র দর্পন
|
১৯০৯
|
খুলনা, যশোহর
|
শশি কুমার বাড়ৈ বিশ্বাস
|
নমঃশূদ্র দ্বিজতত্ত্ব
|
১৯১১
|
বিরশালের মালুহারগ্রাম
|
ঠাকুর পঞ্চানন
|
উত্তরবঙ্গ সাহিত্য পরিষদ
|
১৯১১
|
মাথাভাঙ্গার খালসামারি গাঁ
|
শ্রীবর্মা
|
রংপুর সাহিত্য পরিষদ
|
১৯১১
|
রংপুর
|
বলরাম সরকার
|
নমঃশূদ্র জ্ঞান ভাণ্ডার
|
১৯১১
|
ফরিদপুর জেলার উলপুর
|
জ্ঞানেন্দ্র মজুমদার
|
নমঃশূদ্র চন্দ্রিকা
|
১৯১৩
|
যশোহর
|
মনোহর মৌলিবিশ্বাস
|
চতুর্থ দুনিয়া
|
১৯৯৪
|
কলকাতার ভবানী দত্ত লেন
|
এছাড়াও আরো বেশ কিছু পত্রপত্রিকা বাংলা দলিত সাহিত্য আন্দোলনে
বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। আসলে, এভাবে দলিত মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রসার এমনকি,
বর্ণ-বৈষ্যমের বেড়াজাল ছিন্ন করার লক্ষ্যে অনেকেই নীরবে কাজ করে গেছেন। কিন্তু
দূর্ভাগ্য, তাঁদের কথা ইতিহাসে সেভাবে উঠে আসেনি। মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলের দলিত
আন্দোলনের প্রথানুসারি মহিয়সী নারী সাবিত্রী বাঈ ফুলে, যিনি নারী বিদ্যালয়ের প্রথম
প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষয়িত্রী; এঁদের কীর্তিগাথা ইতিহাসে উঠে আসবে কি? তপশিলীদের
মধ্যে শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে অন্ত্যজ বাঙলার প্রায় ১০৬৭টি গ্রামে মহামানব
গুরুচাঁদ ঠাকুর, বিদ্যাসাগরের সমকালে পাঠশালা খুলে ছিলেন। কিন্তু, দূর্ভাগ্য ঐ সকল
মানব দরদীদের কথা ইতিহাসে সেভাবে উঠে আসেনি। এমন অনেক দলিত জাতির মুক্তিকামী মহান
মহিয়সী সংগ্রামী মানুষদের অজানা কথা আজ ইতিহাসের অন্তরালে চাপা পড়ে আছে। তাঁরা আজ
বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে গেছেন। কে তাঁদের আগামীর ইতিহাসে তুলে ধরবে? এ জন্যই
বোধহয় সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন: ‘বাঙালীর
ইতিহাস নাই’। কারণ, ইতিহাসের আলোকেই, অতীত ভারতের সমাজ সংস্কৃতি ও বাস্তব জীবনের
সমস্যা সঙ্কটের নানান অজানা দিকগুলো আমরা উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে দেখেছি। কিন্তু,
দুর্ভাগ্য উচ্চবর্ণের ইতিহাসকেই আমাদের মূল ইতিহাস বলে সাদরে গ্রহণ করেছি।
সাথে-সাথে নিম্নবর্গীয় সমাজেরও যে একটা ইতিহাস থাকতে পারে তা, সরাসরি অস্বীকার না
করলেও, সহজেই এড়িয়ে যেতে পেরেছি। আসলে –
“শুধু আগে যেখানে ঠাকুর দেবতাও
রাজারাজড়ার লীলাকেই ইতিহাসের মূল বিষয়বস্তু বলে মনে করা হত, এখন তারই বদলে
ইতিহাসের পাতা জুড়ে বসল ইংরেজের মাহাত্ম্য ও ইংরেজ শাসিত সমাজে যাদের টাকা জমি জাত
পেশা বা চাকরির জোর বেশি তাদেরই মাহাত্ম্য। এই মুষ্টিমেয়র ইতিহাস কেই চালানো হল
এবং এখনও চালানো হচ্ছে ভারতবর্ষের ইতিহাস বলে।”
তাই, এই ইতিহাস ফেলে দলিতেরা তাঁদের শোষিত জীবন মুক্তির স্বপ্নে
স্বতন্ত্র রূপে গড়ে তুললেন, তাঁদেরই লাঞ্ছনা মুক্তিকামী-সংগ্রাম-সংকল্পঘন
ঝঞ্জাক্ষুব্ধ জীবনেতিহাস। শুরু হল দলিত
সাহিত্যের ইতিহাস তথা, দলিতদের লেখনী বলে ফুটে ওঠা ‘দলনের ইতিহাস’। এক সুখের বিষয়
নিম্নবর্গের জীবন সমস্যা-সঙ্কট; তাঁদের ঐ লাঞ্ছনা মুক্তিকল্পে বাংলা সাহিত্যে বেশকিছু
মানবদরদী কথাশিল্পী আভিজাত্যের অহং সরিয়ে রেখে, পরমসহানুভূতি দিয়ে লেখনী ধরেছেন।
এঁদের মধ্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, সমরেশ বসু এমনকি, মহাশ্বেতা দেবী পর্যন্ত
সাঁওতাল-লোধা-শরবদের সংগ্রামী জীবন লিখতে গিয়ে এক সময় হয়ে উঠেছেন ‘শবর জননী’ ও
‘লোধা মাতা’। একসময় মহাশ্বেতাদেবীর মনেও প্রশ্ন জেগেছিল – ইতিহাস কি শুধুই রাজারাজড়াদের
বিবাদ-বিসম্বাদ? তা নয়। মহাশ্বেতাদেবীর মতে প্রকৃত –
“ইতিহাসের ধারায় শিক্ষিত হতে হলে একজন বিবেকবান
শিল্পীকে জানতে হবে সেই অঞ্চলের ভূগোলকে, সমগ্র মানব সমাজকে, তাদের শিক্ষা ,
সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলকে।”
তাই তিনি লোধা-শবরদের মধ্যেকার সাংস্কৃতিক
সম্মিলন বাড়িয়ে তুলতে, পুরুলিয়ার ‘শবর’ মেলা নিজেই দেখাশোনা করতেন।
যাইহোক, তবুও বলাযায় –
এঁদের সবকটা শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্ভার কিন্তু তৃতীয় পুরুষের জবানবন্দীতে সৃষ্ট। দূর
থেকে দেখা সহানুভূতির দৃষ্টি দিয়ে লেখা। এঁদের ব্যতিক্রম হিসাবে মহাশ্বেতাদেবীই
কেবল ঐ জীবনের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন একেবারে দ্বিধাহীন চিত্তে। তা
সত্ত্বেও এই শ্রেণীর সাহিত্য স্রষ্টাদের সৃষ্টিকে কেউ কেউ আবার দলিত সাহিত্যের
সৃষ্টি সম্ভারের তালিকায় ফেলতে নারাজ। একদিকে প্রবল সহানুভূতি দিয়ে সৃষ্টি আবার;
আবার অপর দিকে স্বয়ং দলিতদেরই আত্মকথনে সমৃদ্ধ সমানুভূতিতে পূর্ণ – দুই সাহিত্যের
মধ্যে ভেদ যাই থাক; এই ‘দলিত সাহিত্য’ নিয়ে উদ্ভূত যে এক নব ধারার আন্দোলন বাংলা
ভাষা ও সাহিত্যচর্চার ইতিহাসে – এর ভূমিকা আজ অতিগুরুত্বপূর্ণ। দেশগড়ার মতো কাজে
দলিতদের অবদান নাইবা স্বীকৃত হোক; সমাজ উন্নয়ণের ক্ষেত্রে, বুদ্ধিবাদীতায় এঁদের
অবদান হেয় প্রতিপন্ন হতেই পারে। কিন্তু, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় এঁদের সম্প্রভ
প্রতিভাকে আজ অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। দলিত লেখকগণ তাঁদের চারপাশের বিপুলায়তন
অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে আত্মজৈবনিক উপদানে সৃজিত সাহিত্য চর্চায় এক নবধারার ইতিহাস
নির্মাণ করে চলেছেন। সেই সব বেশকিছু প্রতিভাধর কথাশিল্পীর মধ্যে উল্লেখ্য মারাঠি
লেখক সারণকুমার লিম্বালে, যাঁর মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে লেখা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস
‘বেজন্মা’কে ঘিরে প্রচণ্ড বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। সারণ কুমারের মা’কেবল দু’মুঠো
অন্নের জন্যে তিন-তিনজন জমিদারের কাছে বিক্রি হয়েছিল। সারণকুমার তাঁর সেই নিগ্রো
অভিজ্ঞতা এবং আত্মজংলি উপলব্ধি দিয়ে নিজের ভাই-বোনেদের ও চরম উপলব্ধির ছবি
তুলেধরেছেন ‘আক্কার মাসিতে’। কৃষ্ণসাহিত্যে নিগ্রোজীবনের দলনের সেই মর্মান্তিক ছবি
সারাভারতবর্ষের ঐতিহ্যকে ধরে টান দেয়। শুধু এই নয়, মারাঠি সাহিত্যিকের পর যাযাবর
জনজাতির শতাংশ এবং চামাররাও এই সাহিত্য আন্দোলনের ধারায় এগিয়ে এলেন। দয়াপাত্তয়ারের
লেখনীতে সৃজিত হলো উপন্যাস ‘বলুত’। যার হিন্দিতে নাম ‘অচ্ছুৎ’। প্রকাশকাল ১৯৭৮ এবং
প্রহ্লাদকাম্বলের ‘আয়েৎওয়ানী চোপক্ষী’ (স্মৃতির পখিরা), শংকর বাও এর ‘স্বর্গ ও
নরক’, শান্তাভাই কাম্বলের ‘আমার জীবন কথা’ সহ বেমি কাম্বলের ‘আমার জীবন’ প্রভৃতি
অসংখ্য দলিত জীবনের আত্মকথন বিভিন্ন ভাষা-ভাষি সাহিত্যে ও প্রচণ্ডভাবে সাড়া ফেলে
দিয়েছে। এই সকল সৃষ্টিসম্ভারের মধ্যে মিশে আছে দলিতদের কেবল আত্মকথনই নয়; আছে
আত্মপরিচয় এমনকি, আত্মাবিষ্কারও। যে আত্মপরিচয়ের ভেতরে রয়েছে তীব্র ঘৃণা আর
গ্লানিকর যন্ত্রণা, সাথে সাথে সেই আত্মাবিষ্কারে মিশে রয়েছে প্রচণ্ড শ্লাঘা ও
গৌরব। দলিতেরা বিশ্বাস করেন, কেমন করে নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠা অর্জন করতে হয়। তাঁরা
জানেন কেমন করে আত্মমর্যাদা আর অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়। তাইতো দলিতের কবিতায় সেই
সুর স্পষ্ট ধরা পড়ে হরিজন বালক হীরা সিংহ এর আত্মপ্রতিষ্ঠার সংকল্পঘন গল্পের ভেতর
দিয়ে –
“... হীরা সিং হরিজন,
সবেমাত্র অঙ্কুরিত বীজ
সম্ভবত রক্তে আছে প্রপিতা
মহের ক্রুদ্ধ পবিত্রতা
এই ছোট্ট বালক কি জানে,
তারই আত্মীয় এক জোর করে
স্কুলে যেত
পড়ার সময় পেত না আসন
কারন সে বালকও ছিল
হীনজন, ব্রাত্যজন।
তবুও লেখা পড়া সেরে সেই
বালকই
একদিন জোর করে বসেছিলেন
রাষ্ট্রীয় চেয়ারে,
সেই বালকই একদিন কালো
সাহেব হলেন
কালো মানুষের প্রিয়জন
বাবা সাহেব।
হীরা সিং হরিজন শোনো
আমারাতো তোমাকে চেয়ার
দেব না,
তুমি
বড়ো হয়ে,
জোর করে বসো।”
প্রগতি সাহিত্য শিল্প
নির্মাণে অভ্যস্ত অভিজাত লেখককুল এমনকি, কোনো কোনো সমাজতত্ত্ববিদ মনে করেন, যাদের
ভাষা নোংরা, যারা অ-খাদ্য, কু-খাদ্য খেয়ে বেড়ে ওঠে, যাদের পোশাক-পরিচ্ছদ ভালো নয়,
কুঁড়ে ঘরে বাসকরে, যাদের কোনো সামাজিক স্ট্যাটাস নেই; কথাবার্তায় সুশ্রী নয় –
এধরণের অবতলেরা অস্পৃশ্য শ্রেণীর ভেতর থেকে কেউ কেউ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে
উঠলেও, এদের সৃষ্ট সাহিত্যে সেরকম নন্দনতত্ত্ব ফুটে ওঠা সম্ভব কি? – এর উত্তরে বলা
যায়, দলিত সাহিত্য নন্দনতত্ত্বের ধার ধারে না। এই সাহিত্য প্রথাগত রীতি ভেঙে সাহিত্যে
নতুন নন্দনতত্ত্ব তৈরী করে। এঁরা কেবল চোখে দেখা বাস্তবকে, নববাস্তব রূপে ইতিহাসের
সত্যতায় প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। লেখক আর তাঁর সৃষ্ট চরিত্র সকল যখন এক মাটির নির্মাণ
হয়; তখন সেই লেখার নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে সন্দিহান থাকতে পারে কি? এর জ্বলন্ত
দৃষ্টান্ত তো অদ্বৈতমল্ল বর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস। এমনকি, পূর্ব
মেদিনীপুরের এগরার অখ্যাত রুক্মিণীপুর গাঁ’য়ের মাটিতে বেড়ে ওঠা দলিত সাহিত্যিক
অনিল ঘড়াইয়ের সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্ভারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঐ – পূর্ব
মেদিনীপুরের তমলুক অধ্যুষিত নদী তীরবর্তী এলাকার নুনমারাদের জীবনালেখ্য নিয়ে
উপন্যাস – ‘নুনবাড়ি’ (১৯৯১)। যা, বর্তমান কলকাতা বাইমেলা (ইং ২০১৭)র বেস্টসেলার
গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া, তাঁর ‘মুকুলের গন্ধ’ (১৯৯৩), ‘মেঘজীবনের তৃষ্ণা’
(১৯৯৬), ‘সামনে সাগর’ (২০০৩), ‘দৌড়বোগাড়ার উপাখ্যান’ (১৯৯৭) সহ ঝাড়খণ্ডের দলিত
সাঁওতাল জীবন নিয়ে লেখা ‘বনবাসী’ (১৯৯৮)উপন্যাস উল্লেখযোগ্য। তারাশঙ্কর পুরষ্কারে
ভূষিত (২০০১) তাঁর ঐ ‘মেঘজীবনের তৃষ্ণা’ সহ বঙ্কিম পুরস্কারে (২০১০) সম্মানিত
‘অনন্তদ্রাঘিমা’, এমনকি, ‘বনবাসী’র জন্য দিল্লী থেকে তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি
শঙ্করদয়াল শর্মার হাত দিয়ে পাওয়া সর্বভারতীয় ‘সংস্কৃতি’ পুরস্কার (১৯৯১) এছাড়া;
ভারতীয় এমদেমী পুরস্কারে ভূষিত দেবানুর মহাদেবের উপন্যাস ‘কুসুমবালে’ (১৯৯১) সহ
একেবারে সাম্প্রতিক মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সাড়াজাগানো উপন্যাস ‘চণ্ডাল জীবন’ বাংলা
ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে অন্য এক পৃথিবীর সন্ধান দেয় । বর্ধমান থেকে প্রকাশিত
হরিদাস পালিত-এর আত্মচরিত মূলক গ্রন্থ ‘একজন পতিত জাতির কর্মী’ (১৯১৫), মহীতোষ
বিশ্বাসের ‘মাটি এক মায়া জানে’, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের ‘উজান তলীর উপকথা’, সমরেন্দ্র
বৈদ্যর ‘পিতৃগণ’, সুনীলকুমার দাসের ‘দলিত মানুষের গল্প’ ও ‘ব্ল্যাক দলিত’, ড.
মনোরঞ্জন সরকার রচিত ‘একজন দলিতের আত্মকথা’ সহ অসংখ্য দলিত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম সব
সৃষ্টি সম্ভার। এ সবই দলিত সাহিত্য আন্দোলনের বিজয় গৌরব। আর একাজে সিদ্ধ হতে
তাঁরাই পারেন, -
“আত্মোন্নয়নের সংগ্রামে
যে হৃদয় সিক্ত, মনুষ্য হয়েও মনুষ্যেতর জীবনের লাঞ্ছনা-কাতরতায় যে হৃদয় নিঃশেষিত,
বর্ণ বিভাজিত সমাজ ব্যবস্থায় আত্মপরিচিতি প্রকাশমান হতে না হতেই যে হৃদয়
অসন্মানিত, তার অন্তর্দহনে এবং মন্থনে উত্থিত হয় গরল, উত্থিত হয় সুধা। বাংলা ভাষা
ও সাহিত্যে দলিত মানুষের সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংগ্রামী ইতিহাস সুধা ও গরলে মিশ্রিত
ধারা।”
যে ধারায় প্রতিনিয়ত
সৃজন-আন্দোলন ও নির্মাণ কল্পের মধ্য দিয়ে এক নব ইতিহাস রচিত হয়ে চলেছে।
।। গ্রন্থ ঋণ ।।
ক)
সহায়ক গ্রন্থ:
১। দলিত
সাহিত্যের রূপরেখা – মনোহর মৌলি বিশ্বাস, বাণীশিল্প, কলকাতা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭।
২। নিম্নবর্গের ইতিহাস –
গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদিত), আনন্দ পাবলিশার্স প্রা: লি:, কলকাতা,
অষ্টম মুদ্র: জুলাই ২০১৫।
৩।
বাবা সাহেব ড. আম্বেদকর রচনা সম্ভার (প্রথম খণ্ড), পিপল এডুকেশন সোসাইটি, কলকাতা,
নভেম্বর ১৯৯৫।
খ)
সহায়ক পত্র-পত্রিকা:
১। কালি ও কলম – সম্পাদক:
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দ্বিতীয় বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, আক্টোবর ২০১৬।
২। নাব্যস্রোত – সম্পাদক:
ইয়াসিন খান, সপ্তম বর্ষ, প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা, আগাস্ট ২০১৩ ও ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
3। Baba Saheb Ambedkar,
Souvenir, Nagpur, Dalit Sahitya Sammelan 1976.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন