-->

অনিল ঘড়াইয়ের কথাশিল্পে হাট-জীবন -চঞ্চল কুমার মণ্ডল

অনিল ঘড়াইয়ের কথাশিল্পে হাট-জীবন -চঞ্চল কুমার মণ্ডল

অনুমেয় যে, সংস্কৃত ‘হট্ট’ শব্দ থেকে বাংলায় ‘হাট’ শব্দটির উদ্ভব। কারণ, যে স্থানে কেনা-বেচার পালা চলে, সেই স্থানকে ঘিরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের হই-হট্টগোল, চেঁচা-মেচিতে পরিবেশ কোলাহল পূর্ণ হয়ে ওঠে। তাই, ঐ স্থানের নাম ‘হট্টরোল’, কিংবা ‘হট্টগোল’ থেকে সংস্কৃতে এবং ক্রমে বাংলায় ‘হাট’ শব্দের উৎপত্তি। রাজা রাধাকান্ত দেবের ‘শব্দকল্পদ্রুম’ গ্রন্থে এই ‘হাট’ শব্দের উৎপত্তি হিসাবে পাওয়া যায়— ‘হট্টচৌরক’ অর্থাৎ, তৎকালে হাটে চোরের উপদ্রব ছিল। আবার, ‘হট্টবিলাসিনী’ শব্দের মধ্য দিয়ে হাটে সুগন্ধি দ্রব্য বিক্রেতাদের কথাও জানতে পারা যায়
এই ‘হাট’ শব্দটি তাই একেবারে যে সুপ্রাচীন, তাতে আর কোনো সন্দেহই নেই। এমনকি, বৈদিক যুগে দেখা যায় ঐ পণ্যদ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয় স্থানকে ‘পণ্যভূমি’ নামে উল্লেখ করা হয়েছেআবার, ভারতীয় ঐতিহ্যের চূড়ান্ত স্বাক্ষর ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারতে’র মতো মহাকাব্যের যুগেও হাটের প্রসঙ্গ রয়েছে। সেখানে ক্রয়-বিক্রয়ের স্থানকে বলা হয়েছে ‘বিপনাপনম্‌’। পৌরাণিক শাস্ত্রগুলিতে আবার ক্রয়-বিক্রয়ের স্থানকে ‘কুলসন্নিধৌ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই যে ক্রয়-বিক্রয়ের উদ্দেশ্য হিসাবে বাণিজ্যিক স্থানের এত বিচিত্রপূর্ণ নাম,— এগুলি সবিই ঐ ‘হাট’ শব্দেরই পূর্বতন নাম।

আর, গ্রামসমাজে প্রচলিত সেই আদি প্রবাদ

লা লষ্ট ঘাটে, মায়্যা লষ্ট হাটে।

অর্থাৎ লা-অর্থে নৌকার হাল। যা, ঘাটে পড়ে পড়ে রৌদ্র-জলে ক্রমে নষ্ট হয়ে যায়। তেমনি গ্রামজীবনের আদি বিশ্বাস মেয়ে হাটে গেলেই নাকি তার স্বভাব চরিত্র একেবারে খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু ক্রমে এই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। হাটে এখন পুরুষ অপেক্ষা মেয়েরাই বেশি করে যায়। কারণ মেয়েরাই সংসারের সর্বময়কর্তৃসংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র তারাই একমাত্র দেখে শুনে কিনতে পারে। নারী শুধু ক্রেতাই নয়, বিক্রেতাওগ্রামজীবনের বহু নারী কেউ সব্জি বেচে, কেউ বা বেচে মাছ। আবার আদিবাসী জীবনের নারীরা তো গাছের পাতার দোনা বানিয়ে কেউ বা বাখরগুটি হাঁড়িয়া বেচে, বেচে মাংস, মধু এমনকি চোলাই মদও (গল্প: ‘লু’), পিঁপড়ের ডিম (গল্প: ‘পিঁপড়েজীবন) ইত্যাদি পসরা নিয়ে হাটে বসে। যার জটিল-কঠিন যাপন পদ্ধতিতে ধড়া পড়ে। ‘দোনা’ গল্পে সেই পাতার দোনা বানিয়ে বিক্রি করে অরণ্য নির্ভর জীবনের নর-নারীরা কোনো রকম বেঁচে থাকে। ‘উরাংগাড়া’র মতো বিখ্যাত গল্পেও দেখা যায় সেই প্রান্তজ-চিরবুভূক্ষু নারী বুদ্‌নী চিহড়লতার ‘টুকরি শিকারসা’ বানিয়ে হাটে বেচতে যাওয়ার চিত্র লক্ষ্য করা যায়। শুধু বুদ্‌নীই নয়, ‘টিকলি’ গল্পেও শোনা যায় টিকলির মা চাঁদমণির হাঁড়িয়া হাটে হাঁড়িয়া বানানোর খ্যাতি। এমনকি, ‘আকাশ-মাটির খেলা’ গল্প গ্রন্থের সোমরা, গুরুবারি, যাযাবর বিন্দিয়া কিংবা, মদভাটির মালকিন কুমকুমমুখীরা হাঁড়িয়ার হাটে পসরা সাজিয়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজগারের ধান্দা করে। হাঁড়িয়ার হাট এই হাড় জিরজিরে নারীদের বেঁচে থাকার একমাত্র নিদান। অনিল ঘড়াইয়ের সাহিত্যে প্রবেশের পূর্বে আমরা যদি একটু সেই আদি-মধ্যযুগের সাহিত্যের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে সেখানেও দেখতে পাই নারীই সংসারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে হাটের পথে পা বাড়িয়েছে। বড়ু চণ্ডীদাস রচিত ‘রাধা-কৃষ্ণ’ প্রেম গীতিকায় কান পাতলেই শোনা যায় দধি-দুগ্ধ মাথায় নিয়ে হাটের উদ্দেশ্যে গোপকন্যারা সহ রাধিকার পদ-যাত্রার নিক্কন ধ্বনি। রাধিকার উক্তিতেই শোনা যায় –

ও কুলেতে মথুরা মাঝে যমুনা নদী। 
ও আরিতেঁ পার হ-আঁ বিকনিবোঁ দধী।।

        ব্যাধজীবনের রমণী ফুল্লরা হাটে মাংসের পসরা নিয়ে বসত। মাংস বিক্রি করে এই ব্যাধ রমণী সংসারের নিত্যদিনের যাপনক্রিয়ায় অতি দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করেছে। উক্ত ঐ ‘কালকেতু সমীপে ভাঁড়ু দত্তের আগমন’ অংশে যার উজ্জ্বল সাক্ষর মেলে; -

তিন গোটা শর ছিল একগোটা বাঁশ।  
হাটে হাটে ফুল্লরা পসরা দিত মাস।।

কেবল হাটেই নয়, দারে দারে এই ব্যাধ রমণী মাংসের পসরা মাথায় নিয়ে ঘুরেছে। মাংস বিক্রিকে সম্বল করেই এই ব্যাধ জীবনের জঠর নিবৃত্তি ঘটে। তাই হাটে মাংস বিক্রি না হলে সে বাড়িতে বাড়িতে মাংস বিক্রির উদ্দেশ্যে ঘুরে ফিরেছে। কিন্তু সেই মাংস বিক্রিতে ব্যর্থ ফুল্লরা হতাশ হয়ে বলেছে –

মাস মধ্যে মাইসর আপনি ভগবান। 
হাটে মাঠে গৃহে গোঠে সবাকার ধান।।

এমন দারিদ্র্যপূর্ণ সংসারে স্বামী দ্বিতীয় দ্বার গ্রহণ করেছে বলে ভুল বুঝে (ছদ্মবেশী দেবী চণ্ডীকে চিনতে না পেরে) মনের দুঃখে ফুল্লরা আপন কষ্ট বুকে চেপে হাটের পথে পা বাড়িয়েছে। হাটের কর্মচঞ্চল অসংখ্য মানুষের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে হয়তো ক্ষণিক দুঃখ ভুলে থাকার উদ্দেশ্যেই তার এই যাত্রা –

কান্দিতে কান্দিতে রামা গোলা হাট চলে। 
তিতিল সকল অঙ্গ লোচনের জলে।।

        যেমন করে শিল্পী অনিল ঘড়াইয়ের ‘বক্ররেখা’ উপন্যাসের লাট্টুসিং-এর স্ত্রী মালতী পরপুরুষ রবার্টের হাত ধরে পালিয়ে গেলে লাট্টুসিং অপমান জনক দুঃখ ভুলতে মদভাটিতে ডুব দেয়। ছুটে যায় মুরগি লড়াইয়ের মাঠ, লাউড়িয়া ঢিপির হাটে। নারীর দ্বারা প্রতারিত লাট্টুসিং মনে করে মদের ঠেক, হাঁড়িয়ার হাট, এমনকি ঐ মুরগি লড়াই মাঠের হাটেই রয়েছে প্রকৃত জীবনের স্বাদ। এই উপন্যাস বিহারের চক্রধরপুর অঞ্চলের লাউড়িয়া ঢিপির হাট, ইতোয়ারি বাজার হাটের মুরগি লড়াই-এর ছবিকে ঘিরে ব্রাত্য জীবনের হাঁড়িয়া হাটের সজীব চিত্র উঠে এসেছে। এই সব হাটে কেবল জিনিসপত্রের দরদাম হয় না। এক সময় এই সব হাটে তৈজসপত্রের দ্বারা বিনিময় প্রথাও ছিল সভ্যতার ঊষালগ্নে। ক্রমে মুদ্রা ব্যবস্থায় টাকার বিনিময়ে বেচা-কেনা শুরু হল। অভাবগ্রস্ত এই ব্যাধ রমণী ফুল্লরা মাংস বিক্রি করে তারপর –

পসরা চুবড়ী পাখি লইল ফুল্লরা। 
ছাড়িলেন গোলা হাট তুলিয়া পসরা।।

গুজরাট নগরস্থিত ঐ গোলাহাটের অবস্থান প্রসঙ্গে কবি কঙ্কণের দেওয়া বর্ণনায় পাওয়া যায় –

দক্ষিণে বিজয়ীপুর বামে গোলা হাট। 
সম্মুখে মদনপুর সওয়া কোশ বাট।।

        ‘বৈষ্ণব সাহিত্য’ এবং ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে যেমন উল্লেখিত রয়েছে মথুরার হাট, গোলা হাট প্রসঙ্গ; তেমনি অনিল ঘড়াইয়ের গল্প-উপন্যাসে প্রান্তিক জীবনপটে ঐ জীবনের বেঁচে থাকার নিদান হিসেবে অসংখ্য বিচিত্রপূর্ণ সব হাটের চিত্র উঠে এসেছে। ‘দৌড়বোগাড়ার উপাখ্যান’ উপন্যাসের দৌড়বো নালার বুকে স্বর্ণ রেণু সন্ধান পিয়াসী মানুষের ক্ষুণ্নি বৃত্তির উপায় হিসেবে ফুটে উঠেছে গোয়েলকেয়ার হাট, লোটা পাহাড় হাটের স্বজীব-বৈচিত্র্যময় চিত্র। পশ্চিম সিংভূমের আদিবাসী জনজীবন বর্ষায় পাহাড় চুয়ানো জলে মিশে থাকা স্বর্ণরেণুর সন্ধানে ছুটে যায় সিংভূমের অরণ্য অধ্যুষিত নদী-নালার ধারে। এতেও এদের জঠরের তৃপ্তী মেটে না। তাই বিকল্প পথ হিসেবে জঙ্গলের কাঠ চুরি করে কেটে এনে তারা গোয়েলকেয়ার বাজারে বিক্রি করে।

        কথাশিল্পীর ‘বনবাসী’ উপন্যাসে সিংভূমের আদিবাসী জনজীবনের নিত্য দিনকার জঠর যুদ্ধের কেন্দ্রভূমিতে অবস্থান করেছে মুরগি লড়াই মাঠের হাট সহ হাঁড়িয়ার হাট, ইতোয়ারি বাজার হাট, লাউড়িয়া ঢিপির হাট প্রভৃতি সব বৈচিত্র্যপূর্ণ হাটের সজীবঘন চিত্র ধরা পড়েছে। এছাড়া ‘মেঘজীবনের তৃষ্ণা’ উপন্যাসে চোরাপালিয়া হাট, খড়িকা হাট সহ অসংখ্য নিম্নবৃত্তিয় জীবনের জটিল কঠিন জঠর লড়াই-এর ছবি ঐ হাটের অনুষঙ্গেই উঠে এসেছে। এই সব হাটের সজীব চিত্রের মধ্য দিয়ে আদি যুগের চর্যাপদের ‘শুণ্ডী’ রমণী কিংবা মধ্যযুগের রাধা বা ফুল্লরাদের মতো সমকালীন অনিল ঘড়াইয়ের কথাশিল্পে প্রান্তজ নারীরাই বরং বেশি করে হাটের মধ্যে ভিড় জমিয়েছে। কেবল তাঁর উপন্যাস শিল্পেই নয়, অসংখ্য ছোটগল্পের কাহিনী চিত্রণেও হাট অনুষঙ্গ ঘুরে ফিরে এসেছে।

        ‘টিকলি’ গল্পে সংস্কারাবদ্ধ আদিবাসী সমাজে হাঁড়িয়ার হাটকে কেন্দ্র করে ব্রাত্য জীবনের রুদ্ধ সঙ্গীত শুনিয়েছেন অত্যন্ত জীবনসংবেদী কথাশিল্পী অনিল ঘড়াই। কাটারী পাহাড়-মুরী টুংরী স্টেশন স্থিত হাট ‘উরাংগাড়া’ গল্পে প্রান্তজ-চিরবুভূক্ষু নারী বুদ্‌নীদের একমাত্র বেঁচে থাকার নিদান। যে হাট ঐ সকল দারিদ্র্য ক্লিষ্ট অন্তেবাসী নরনারীর ক্ষুণ্নিবৃত্তির সহায়-সম্বল ক্ষেত্র। গল্পশিল্পীর বর্ণনায় চির অভাবী বুদ্‌নীর জঠর সংস্থানের উপায় হিসেবে তাই হাটের ভূমিকাকে এনে বলেছেন – 

...বুদ্‌নী একটা অশিক্ষিত মেয়ে, যার কোন নির্দিষ্ট সমাজ নেই, যে দুবেলা পেটপুরে খেতে পায় না, চিহড় লতার টুকরি-শিকা-রসা বানিয়ে হাটে গিয়ে বেচতে যায়।

        আবার গল্পশিল্পীর ‘মুগনী পাথর’ গল্পের চিরান্নহীন বিধবা ঢিলি হাটে ছাচুন (ঝাঁটা) বিক্রি করেই ক্ষুণ্নিবৃত্তির চেষ্টা করে। কাঙ্গাল ঐ হাটে তোলা তুলতে যায়। সেই সূত্রে নিঃসন্তান কাঙ্গালের সঙ্গেই ঢিলির অবৈধ সম্পর্ক সূচিত হয়। খেজুর পাতার ছাচুন। টাকায় দুটো। কাঙ্গাল গিয়ে তোলা চাইল ঢিলির কাছে। হাট ঝাঁটানোর তোলা। ঢিলি হা করে তাকিয়ে থাকে। অস্পষ্ট গলায় শুধায় – “গটে টাকা মোটে বিচচি। এর থিকে কি দিবা তুমায়? মোর দুয়ারে দুটা পেট, গটে টাকায় কি হয়?”১০ ঢিলির এই দারিদ্র্য ক্ষত রৌদ্রদগ্ধ জীবনে কাঙ্গাল এসে ছায়া দেয়। কাঙ্গাল তাকে হাটের আটচালাতে আশ্রয় দেয়। এই নিয়ে সারা হাট জুড়ে ঢিঢি পড়ে যায়। সব অপমান গায়ে মেখে কাঙ্গাল এবং ঢিলি সামান্য ছাচুন বিক্রিকে কেন্দ্র করে হাটজীবনেই বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নেয়।

        ‘মুগনী পাথর’ গল্পের ঢিলির মত ‘পোকাপার্বণ’ গল্পের চির অভাবগ্রস্ত নারী তারামণি ও তার মেয়ে লারানীকে হাটে ছাচুন বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহের কথা ভাবে। আবার ‘কানাকড়ি’ গল্পে দেখা যায় মাত্র ন’টা কানাকড়ি দিয়ে ন’কড়িকে কিনে ছিল তার যমুনা মাসি। যে ন’কড়ির পেশা ছিল পরের বাড়ির গরুর দুধ দোহন করা। এমন বিচিত্র পেশার অসহায় ন’কড়ির জীবনেও প্রেম আসে। তাকে ভালোবাসার বন্ধনে বাধে হারাধন মোড়লের মেয়ে আল্পনা। মূর্খ ন’কড়ি আল্পনা নাম উচ্চারণ করতে পারে না। তাই তাকে আলতা দিদিমণি বলেই ডাকে। ন’কড়ি তার ভালোবাসার নারী আলতা দিদিমণিকে নিয়ে গান বাঁধে। যে বোলান গানে উঠে আসে এক বিচিত্র নামের হাট অনুষঙ্গ।

তোমার চোখের মধ্যে পাখি ওড়ে ওগো দিদিমণি। 
তুমি লাখুরি হাটে ফিতে কিনে কইসে বাঁধো বেণী

এই গানে উল্লেখিত ‘লাখুরি’ হাট হল লাখপতিদের হাট। ঐ ‘লাখপতি’ থেকে এই হাটের নাম হয়েছে ‘লাখুরিয়া’ হাট।

        উক্ত গল্পের ন’কড়ির মতো ‘কটাশ’ গল্পে ভাকুকানা ধূর্ত নারী লোলুপ ছকু সাউয়ের বিরুদ্ধে গান বেঁধে প্রতি হাটবার হারমোনিয়াম বাজিয়ে সে গান গায়এই গল্পে কটাশের রূপকের আড়ালে দুঃশ্চরিত্র ছকু সাউদের মুখোশ খুলে দিতে অন্ধ ভাকু হাটের মাঝে গান গায়। ছেঁড়া চট পেতে হারমোনিয়ামের বোলে প্রতি হাটবারে সুর তোলে। হাটুরেরা তার গানে মুগ্ধ হয়ে পয়সা দেয়। হাটকে নির্ভর করে সমাজ শোষিত ভাকুকানা ও তার বোন অহল্যা বেঁচে থাকার পথ খুঁজে পায়।

        আবার ‘পরীযান’ গল্পে দেখা যায় হাট পোষ্ট অফিসের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। হাটের মধ্যেই চিঠি বিনিময় হত। হাট হল পোষ্ট বক্স। গ্রামজীবনের ডাক ব্যবস্থা ঐ হাট। মুচিয়া ভালোবাসত ময়নাকে। কিন্তু ময়নার বিয়ে হয় অন্যত্র। দুর্ভাগ্যক্রমে শ্বশুর ভিটেতে জায়গা হলো না ময়নার। ময়নার স্বামী তাকে তাড়িয়ে দিয়ে আবার দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছে। সেই দুঃসংবাদ জানাতে তার নিষ্ঠুর স্বামী ময়নাকে চিঠি লিখেছে। আর সেই চিঠি, – 

হাটের মধ্যে পিয়ন তাকে (মুচিয়াকে) খুঁজে পেতে একটা পোষ্ট কার্ড ধরিয়ে দেয়। বড় বড় অক্ষরে লেখা নিষ্ঠুর কতগুলি কথা। ময়নার স্বামী লিখেছে।

এই গল্পে দাউদপুরের হাট, নানকা-হাতিদা গাঁয়ের হাটের ছবি পাওয়া যায়। যে হাটে – 

চুনো-চাঁদা মাছই যখন ন’টাকা দশটাকা। মুচিয়া আজ হাটে গেলে নোনামাছ আনতে বলবে হাগুরি

        হাটকে কেন্দ্র করে নারী-পুরুষের মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠার চিত্র ‘খালাসী’ গল্পে লক্ষ্য করা যায়। গল্পের নায়ক সাধন বাসে খালাসীর কাজ করে। তার নিত্যদিন বাসের মধ্যে কেটে যায়। হাটবার এলেই বাসে ভীড় বেড়ে যায়। আর রোজ ঐ বাসে করে যায় মোকাম পাড়ার মেয়ে ময়না। টিকিট কাটার আছিলায় ময়নার সঙ্গে সাধনের মন দেওয়া নেওয়া ঘটে যায়। ময়না নেমে যায় হাটগাছায়। সাধন সে দিকেই তাকিয়ে থাকে। ময়নাকে সময় দিতে সাধন ছুটি চায়। কিন্তু গোয়াড়ী বাজারের মানিক সিজিনের সময় ছুটি দিতে চায় না। এভাবে খালাসী গল্পে দেবগ্রামের হাট এবং গোয়াড়ী হাটকে ঘিরে নিত্যদিনের যাপন চর্যায় জঠরের তাগিদে ছুটে যাওয়া দুই নারী-পুরুষ সাধন ও ময়না প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। 

        শুধু তাই নয়, কথাশিল্পীর ‘নীলদুঃখের ছবি’ উপন্যাসে যে কাকমারা সম্প্রদায়ের জটিল কঠিন যাপন চিত্রের ছবি ধরা পড়েছে, সেখানেও উঠে এসেছে পূর্বমেদিনীপুরের সাহাড়দা হাটের বাস্তবঘন ছবি। কথাশিল্পীর ভাষায়, - “সাহাড়দা হাটে উদকাঠি আর নজর কাঠি বেঁচতে গিয়েছিল সে (ঝুমরি) আর বিন্দিয়া।”১৪ শুধু তাই নয়, এই উপন্যাসে কমলাবেড়িয়া হাট প্রসঙ্গও ধরা পড়েছে। 

        তারাশঙ্কর পুরস্কারের ভূষিত কথাশিল্পীর ‘মেঘজীবনের তৃষ্ণা’ উপন্যাসে পূর্বমেদিনীপুরের একাধিক হাটের বিচিত্রপূর্ণ ছবি উঠে এসেছে। যে হাটকে ঘিরে ধীবর সম্প্রদায়ের নিত্যদিনের যাপন ছবি ধরা পড়েছে। পাণিপারুল হাটসহ, চোরাপালিয়া হাট, মোহনপুরের হাট অনুষঙ্গ দীঘা সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলের মানুষদের নিত্যদিনকার যাপন ছবি ধরা পড়েছে।

        সুতরাং অনিল ঘড়াইয়ের সমগ্র কথাশিল্প জুড়েই হাট অনুষঙ্গ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। যে হাট কেবল কেনা-বেচার স্থল নয়। ঐ হাটুরে জীবনে মানুষ মানুষের কাছে চলে এসেছে। হাটই মানুষের মধ্যে মধুর সম্পর্ক স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং কথাশিল্পীর দৃষ্টিতে হাট হল মানবজীবনের মিলন ভূমি। আত্মার সঙ্গে আত্মার মেলবন্ধন ঘটাতে হাটই সাহায্য করেছে। হাটের মধ্যে বিচিত্র মানসিকতার মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। নিম্নবিত্ত দারিদ্র্য শ্রেণীর মানুষের কাছে হাট একান্ত আপন। এই হাট তাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বাঁচার নিদান ক্ষেত্রও। কোন কোন হাটে আবার কথাশিল্পীর দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে পুরুষের তুলনায় নারীদের অধিক ভীড়। আলোচ্য এই উপন্যাসে খড়িকা হাট প্রসঙ্গে হরিয়ার চোখ দিয়ে কথাশিল্পী দেখতে পান – 

এই হাট বড় সর্বনেশে হাট। এখানে পুরুষের তুলনায় মেয়েরা হল অধিক।

আসলে ব্যবসা-বাণিজ্য, ভাবের আদান-প্রদান মানব মিলনের ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিটি হাটই শুধু পুরুষদের পেশার স্থল নয়, সর্ব যুগের সর্বকালের নারীর প্রাণের স্ফূরণও। স্বয়ং কথাশিল্পীর ভাষায় – 

হাট এদের নিঃশ্বাস, প্রশ্বাস। এরা তাই গোঁসা হলে বলে – ভাতার ছাড়ি দিব কিন্তু হাট ছাড়াবোক লাই।

        কিন্তু দুঃখের বিষয় হাটজীবন ক্রমশঃ বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনধারা বদলের সাথে সাথে। নগর জীবন এমনকি গ্রামীণ জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও মানুষের অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে গিয়ে হাটের স্থানে গড়ে উঠেছে বাজার। তাছাড়া উৎপাদিত সমাগ্রী ঘিরে লাভের নেশায় ভীড় জমিয়েছে দালাল, আড়ৎদার, ফোড়ে পাইকারের মত মহাজন কারবারীরা। তাই কাউকে আজ সপ্তাহের ঐ একটা নির্দিষ্ট দিনে বসা হাটের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। হাত বাড়ালেই আজ বাজার থেকে যে কোন সময় যে কোন জিনিস কিনে নেওয়া যায়। কিন্তু ঐ হাটজীবন অবলুপ্তির সাথে সাথে লোপ পেয়েছে হাট সংস্কৃতিও। আজ আর রবীন্দ্রনাথের বাল্যস্মৃতিতে ধরা সেই কুমোর পাড়া থাকলেও তাদের গরুর গাড়িটি আজ আর নেই। বক্সীগঞ্জের পদ্মাপারের চেহারা বদলের সাথে সাথে বদলে গেছে হাটজীবন। যে হাট জীবনের স্থান দখল করেছে বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থা, সপিংমল। আসলে ঐ ‘মল’ তো হাটেরই নব সংস্করণ। হাট ব্যবস্থা বিলুপ্তির সাথে সাথে প্রত্যেকটি হাটের ইতিহাস, সংস্কৃতিও মুছে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষের আন্তরিকতা, আত্মীয়তাও ক্রমে মুছে যাচ্ছে। খুলে পড়ছে সেই হাটে ফেরা মানুষের গাঁটে কড়ি বাঁধার মত গাঁটছাড়া। হাটের প্রয়োজনীয়তাকে মানুষ দূরে সরিয়ে আজ সেই স্থানে নিয়ে এসেছে ‘বিগ বাজার’, ‘মল’, ‘কমপ্লেক্স’, ‘সুপার কমপ্লেক্স’-এর মত বিপণন ব্যবস্থাগুলি। যার মধ্যে আছে চমক্‌, ঝমক্‌, আছে কৃত্রিম আলোর ঝল্‌কানি।

        তবে যাইহোক, এই সময়কার কথাশিল্পী হিসেবে অনিল ঘড়াইয়ের দরদী ভরা লেখনীতে গ্রামজীবনের বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া এই হাট সংস্কৃতির নিখুঁত চালচিত্র জীবন্ত রূপে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। আর এখানেই তিনি স্বতন্ত্র কথাশিল্পী। আসলে অনিল ঘড়াই হলেন এমন একজন কথাশিল্পী যিনি বাস্তব জীবনের টোটাল রিয়েলিটাকার। যে কারণে এই বিশ্বায়ণের যুগেও অবস্থান করে তাঁর সাহিত্যিচিন্তাতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন হাটের মত লুপ্তপ্রায় লোকায়ত সংস্কৃতিকে।    

 

 

'অনিল ঘড়াইয়ের কথাশিল্পে হাট-জীবন - চঞ্চল কুমার মণ্ডল' প্রবন্ধটি 'কোরাস ' পত্রিকার 'হাট' সংখ্যায় ৮ জুন ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়।